![]() |
Balancing family life and career |
আজকের যুগে কাজ এবং পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা কর্মরত বাবা-মায়ের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একদিকে ক্যারিয়ারের উন্নতি, আরেকদিকে পরিবারের যত্ন — এই দুই ক্ষেত্রেই সাফল্য অর্জন করতে চাইলে মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। অনেকেই কাজের কারণে পরিবারের প্রতি পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না, আবার পরিবারকে সময় দেওয়ার কারণে কাজের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়ে। এই ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং কিছু কৌশল খুবই জরুরি।
এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করবো কিভাবে কর্মরত বাবা-মায়েরা তাদের পরিবার এবং ক্যারিয়ারের মধ্যে সফলভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন। এখানে কিছু কার্যকরী টিপস ও পদক্ষেপ দেওয়া হলো যা আপনাকে কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে একটি সুস্থ ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
১. পরিকল্পনা এবং প্রাধান্য
পরিকল্পনা করা এবং কাজের প্রাধান্য ঠিক করা কর্মরত বাবা-মায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি কাজ এবং পরিবারের প্রতি মনোযোগ দিতে চান, তবে আপনাকে প্রতিদিনের কাজগুলোর জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হবে।
ক. প্রতিদিনের কাজের তালিকা তৈরি:
প্রতিদিনের কাজগুলো তালিকা করে নিলে কোন কাজ কখন করতে হবে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। একবার কাজের তালিকা তৈরি করলে, আপনি নিজের কাজগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পন্ন করতে পারবেন। এতে করে কাজের চাপ কমে যায় এবং কাজের মানও ভালো হয়।
খ. প্রাধান্য দেওয়া:
সব কাজ সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই কোন কাজটি প্রথমে করতে হবে এবং কোনটি পরে তা প্রাধান্য ঠিক করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবার ও ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে কোন সময় কীভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত তা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন।
গ. প্রযুক্তির ব্যবহার:
পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার জন্য আপনি বিভিন্ন অ্যাপস ও ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতে পারেন। এতে কাজের তালিকা ও সময়মতো কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য হবে। প্রযুক্তির সাহায্যে আপনি সময় ও কাজের যথাযথ ব্যাবস্থাপনা করতে পারবেন।
২. গুণগত সময় কাটানো
পরিবারের সঙ্গে গুণগত সময় কাটানো মানে শুধুমাত্র পরিবারের পাশে থাকা নয়, বরং মানসম্পন্ন সময় কাটানো। কর্মরত বাবা-মায়েরা পরিবারকে সময় দিতে কম সক্ষম হলে, তারা যে সময়টুকু পরিবারের সঙ্গে কাটাবেন তা যেন ফলপ্রসূ হয়, সে দিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
ক. পরিবারের সঙ্গে পরিকল্পিত সময়:
পরিবারের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করা উচিত। যেমন, রাতে একসঙ্গে ডিনার করা বা সপ্তাহান্তে বাইরে কোথাও যাওয়া। এতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন আরও দৃঢ় হয়।
খ. প্রযুক্তিমুক্ত সময়:
পরিবারের সঙ্গে যখন সময় কাটাচ্ছেন তখন মোবাইল, টিভি বা অন্যান্য প্রযুক্তি থেকে বিরত থাকা উচিত। প্রযুক্তি থেকে মুক্ত সময় পরিবারকে আরও কাছাকাছি আনে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়ায়।
গ. পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ:
পরিবারের সদস্যদের বিশেষ দিন বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা উচিত। এটি পরিবারকে বিশেষ অনুভব করায় এবং একটি শক্তিশালী সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তোলে।
৩. কাজের জায়গায় সঠিক ব্যালেন্স
কাজের সঙ্গে পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা কেবল ব্যক্তিগত জীবনে নয়, কাজের ক্ষেত্রেও সফলতা আনে। কর্মক্ষেত্রে যদি চাপ বেশি হয়, তবে তা ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। এজন্য সঠিকভাবে কাজ ও পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত।
ক. ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স:
আপনি যদি বেশি কাজ করেন এবং পরিবারকে সময় দিতে না পারেন তবে কাজের ভারসাম্য ঠিক রাখতে হবে। কাজের সময়সীমা ঠিক রাখার মাধ্যমে আপনি উভয় ক্ষেত্রেই সফল হতে পারবেন।
খ. সহায়ক সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক:
কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা এবং তাদের সঙ্গে কাজ ভাগাভাগি করা উচিত। এটি কাজের চাপ কমাতে এবং কর্মক্ষেত্রে মানসিক শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
গ. কাজের সময়মত সমাপ্তি:
কাজ শেষ করার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া উচিত। কাজে যদি সময় বেঁধে দেওয়া যায়, তবে তা দ্রুত সম্পন্ন করতে পারবেন এবং পরিবারের জন্য সময় বের করতে পারবেন।
৪. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট
কর্মরত বাবা-মায়েদের জন্য স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজ ও পরিবারের চাপে স্ট্রেস একটি সাধারণ বিষয়, তবে এই স্ট্রেসকে যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তবে উভয় ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব।
ক. শারীরিক চর্চা:
নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম স্ট্রেস কমাতে খুবই কার্যকর। ব্যায়াম শরীরকে শিথিল করে এবং মানসিক শান্তি দেয়। তাই কাজের ফাঁকে সময় বের করে ব্যায়াম করা উচিত।
খ. ধ্যান ও যোগব্যায়াম:
ধ্যান ও যোগব্যায়াম মানসিক শান্তি বজায় রাখতে সহায়ক। প্রতিদিন ১০-১৫ মিনিট ধ্যান করলে স্ট্রেস কমে এবং মানসিকভাবে স্বস্তি পাওয়া যায়।
গ. পর্যাপ্ত ঘুম:
কর্মরত বাবা-মায়েদের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমের অভাবে স্ট্রেস বৃদ্ধি পায় এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। তাই প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত।
৫. নিজের যত্ন নেওয়া
পরিবার এবং ক্যারিয়ারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে নিজের যত্ন নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। কর্মরত বাবা-মায়েরা অনেক সময় পরিবারের কথা ভেবে নিজের যত্ন নিতে ভুলে যান। তবে নিজের সুস্থতা বজায় রাখার জন্য সময় বের করা প্রয়োজন।
ক. পুষ্টিকর খাবার খাওয়া:
সঠিক পুষ্টি শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টিকর খাবার খেলে আপনি শক্তি পাবেন এবং কাজ ও পরিবারের মধ্যে সফলভাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবেন।
খ. মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন:
শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া খুবই প্রয়োজন। মানসিক চাপ কমাতে এবং মানসিক শান্তি বজায় রাখতে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া উচিত।
গ. নিজেকে সময় দেওয়া:
কাজ ও পরিবারের চাপে মাঝে মাঝে নিজেকে সময় দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের পছন্দের কাজ করা, বই পড়া বা বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া মানসিক শান্তি এনে দেয়।
৬. পরিবারের সঙ্গে কাজ ভাগাভাগি করা
পরিবারের মধ্যে কাজ ভাগাভাগি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। কর্মরত বাবা-মায়েরা যদি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাজ ভাগ করে নেন, তবে কাজের চাপ কমবে এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
ক. কাজের ভাগাভাগি:
বাড়ির কাজগুলোর জন্য পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দিলে কাজের চাপ কমে যায় এবং সবাই একসঙ্গে কাজ করতে সক্ষম হয়। যেমন, বাচ্চাদের পড়াশোনার সময় বাবা-মা দুজনই সময় ভাগ করে নিতে পারেন।
খ. বাচ্চাদের কাজে অংশগ্রহণ:
বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই পরিবারের কাজে অংশগ্রহণের অভ্যাস করানো উচিত। এটি তাদের দায়িত্বশীলতা বাড়ায় এবং পরিবারের প্রতি তাদের ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
গ. একে অপরকে সমর্থন করা:
পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে সাহায্য করলে কাজের চাপ কমে যায় এবং পরিবারের প্রতি ভালোবাসা ও সমর্থন বৃদ্ধি পায়। তাই পরিবারের কাজে একে অপরকে সহায়তা করা উচিত।
৭. ফ্লেক্সিবল কাজের সময় এবং বাসায় কাজের সুযোগ
কর্মরত বাবা-মায়েরা অনেক সময় ফ্লেক্সিবল কাজের সময় বা বাসায় বসে কাজ করার সুযোগ নিতে পারেন। আজকের যুগে অনেক কোম্পানি কর্মীদের ফ্লেক্সিবল কাজের সময় এবং বাসায় বসে কাজ করার সুযোগ দেয়। এটি কর্মরত বাবা-মায়েদের জন্য একটি ভালো সুযোগ।
ক. ফ্লেক্সিবল কাজের সময়:
ফ্লেক্সিবল কাজের সময় কর্মরত বাবা-মায়েদের কাজ এবং পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক। এটি কর্মীকে সময় ব্যবস্থাপনায় আরও স্বাধীনতা দেয় এবং কাজের চাপ কমায়।
খ. বাসায় বসে কাজ করা:
কিছু কাজ বাসায় বসেও করা সম্ভব। কর্মস্থল থেকে দূরে থাকার কারণে কর্মরত বাবা-মায়েরা প্রায়শই সময় বের করতে পারেন না। বাসায় বসে কাজ করার সুযোগ তাদের জন্য কাজ এবং পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক।
গ. প্রযুক্তির সাহায্যে কাজ:
প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে কর্মীরা এখন ঘরে বসে কাজ করতে পারেন। এতে কর্মরত বাবা-মায়েরা তাদের কাজের সময়কে আরও ফ্লেক্সিবল করতে পারেন এবং পরিবারের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাতে সক্ষম হন।
৮. পেশাদার ও পারিবারিক জীবনের মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা তৈরি করা
কাজ ও পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল উভয় ক্ষেত্রে স্পষ্ট সীমারেখা তৈরি করা। এর মানে হল কাজের সময় এবং পরিবারের সময়ের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজন রাখা।
ক. কাজের সময় নির্দিষ্ট করা:
কাজের সময়কে নির্দিষ্ট করতে হবে, যাতে কাজের সময়ে পরিবারের সঙ্গে বিভ্রান্তি না হয়। কাজের সময় সম্পূর্ণরূপে কাজের প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত, এবং পরিবারের সময় পরিবারের সঙ্গে কাটানো উচিত।
খ. পরিবারকে গুরুত্ব দেওয়া:
কাজের বাইরে সময় বের করে পরিবারকে সময় দিতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানো মানসিক প্রশান্তি দেয় এবং সম্পর্ক দৃঢ় করে।
গ. কাজের ফোন এবং ইমেল সীমাবদ্ধ করা:
কাজের ফোন এবং ইমেল পরিবারকে বিরক্ত করতে পারে। তাই কাজের বাইরে কাজের ফোন এবং ইমেল চেক করার প্রবণতা কমাতে হবে, যাতে পরিবারকে সঠিকভাবে সময় দেওয়া যায়।
পরিবার এবং ক্যারিয়ারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হতে পারে, তবে সঠিক পরিকল্পনা, সময় ব্যবস্থাপনা এবং পরিবারের সঙ্গে সমন্বয় করলে এটি সম্ভব। কাজের সময় কাজ এবং পরিবারের সময় পরিবারে মনোনিবেশ করলে উভয় ক্ষেত্রেই সফলতা আসতে পারে। উপরন্তু, নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিয়ে, পরিবার ও ক্যারিয়ারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা যায়।
পরিবার এবং ক্যারিয়ারের ভারসাম্য: কর্মরত বাবা-মায়ের জন্য টিপস: মূল কথা
- কর্মরত বাবা-মায়েদের জন্য কাজ ও পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
- পরিকল্পনা, সময় ব্যবস্থাপনা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা দিয়ে উভয় ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন সম্ভব।
- পরিবারের সঙ্গে মানসম্পন্ন সময় কাটানো এবং নিজেদের যত্ন নেওয়া কর্মরত বাবা-মায়েদের সুস্থতার মূল চাবিকাঠি।
- কাজ ও পরিবারের মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা তৈরি করা উচিত যাতে উভয় ক্ষেত্রেই চাপমুক্ত থাকা যায়।
- প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে কাজ ও পরিবারের ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব।
No comments:
Post a Comment